কঠিন শাস্তি (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) || 2020 Best Bengali Detective Story – এই বছরের সেরা গোয়েন্দা গল্প








2020 Best Bengali Detective Story – এই বছরের সেরা গোয়েন্দা গল্প

কঠিন শাস্তি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


কঠিন শাস্তি

দই বন্ধুই ক্লাস নাইনে পড়ে, কিন্তু আলাদা ইস্কুলে। ওদের মধ্যে টিটো খুব খেলাধুলাে
ভালবাঁসৈ। পড়ার বই ছাড়া বাইরের বই বিশেষ পড়ে না, বড়জোর দু-একটা ইংরেজি
কমিক্স। আর পাপান খেলার মাঠে বিশেষ যায় না, যখনই একটু সময় পায় অমনই
একটা গল্পের বই নিয়ে বসে। এমনকী একবার টিটোর সঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখাত
গিয়েও পাপান একটা ডিটেকটিভ বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল। পাপান ইংরেজি
বইও পড়ে। বাংলা বইও পড়ে।

এখন একটানা দশদিন স্কুল ছুটি। সকালবেলা পড়াশােনা শেষ করে টিটো যায়
ব্যাডমিন্টন খেলতে, আর পাপান বড় রাস্তার মােড়ে একটা বইয়ের দোকানে এসে
নতুন নতুন বই দেখে, একটা-দুটো কেনে। যাওয়া আসার পথে রােজই প্রায় এক জায়গায়
ওদের দুজনের দেখা হয়ে যায়। গল্প হয় খানিকক্ষণ। টিটো বলে আগের দিনের
ব্যাডমিন্টন ম্যাচে একজনকে হারিয়ে দেওয়ার কথা, আর পাপান বলে, “কাল রাত্তিরে
একটা দারুণ বই পড়লুম, জানিস!”

সকাল সাড়ে দশটায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে টিটো আর পাপান। টিটোর হাতে
ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট, পাপানের হাতে দু’খানা বই। পাশেই একটা ব্যাঙ্ক, সামনের
রাস্তায় তিন-চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
গল্পে-গল্পে ওরা যখন মশগুল, তখন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল একজন লােক। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, সুট-টাই পরা, মাথায় আধখানা টাক। মুখে একটা কেউকেটা ভাব।

লােকটির হাতে একটা চাবি, সেই চাবি দিয়ে একটা গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ
মুখ তুলে সে টিটো আর পাপানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল, “অ্যাই, আমার
গাড়িতে ঠেসান দিয়েছিস কেন রে? সরে যা! সরে যা!”


কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক ভাবে পাপান একটা নীল রঙের গাড়িতে হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই। তাতে কী হয়েছে, গাড়িটা ক্ষয়ে গেছে নাকি? একজন অচেনা
লােক তাদের তুই বলবে কেন?

পাপান সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়িটা থেকে সরে গেল খানিকটা। লােকটির দিকে
তাকিয়ে বলল, “আপনার গাড়িটা ছুঁয়ে ফেলেছি, এজন্য দুঃখিত!”
লােকটি গাড়িতে ঢুকতে গিয়েও এদিকে চলে এল। গাড়িটা যেন একটা পােষা জন্তু,
এইভাবে এক জায়গায় হাত বুলােতে গিয়ে চমকে উঠল। গর্জন করে বলল, “আমার
গাড়িতে আঁচড় কেটেছিস? গাড়িটা নষ্ট করে দিয়েছিস!”।

পাপান সেদিকে তাকাল, গাড়িটার গায়ে সে কোনও দাগ দেখতে পেল না। তা
ছাড়া গাড়ির গায়ে সে আঁচড় কাটতে যাবে কেন ? তাও অন্যের গাড়িতে? একটুখানি
পিঠটা ঠেকিয়েছিল শুধু।

লােকটি রাগে গরগর করতে-করতে বলল, “যত সব বিচ্ছু ছেলে! বদমাশ!’
এবার টিটো বলল, “আপনি গালাগাল দিচ্ছেন কেন? আপনার গাড়ির কোনও
ক্ষতি করা হয়নি!”

লােকটি প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল, “চোপ!”
তারপর দুটো হাতের পাঞ্জা ঠিক থাবার মতন ওদের দুজনের মুখের ওপর রাখল।
এক ধাক্কায় ওদের দু’জনকেই ফেলে দিল মাটিতে। কঠিন ফুটপাথে মাথা ঠুকে গেল
টিটো আর পাপানের।

ওরা আবার উঠে দাঁড়াবার আগেই লােকটি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
টিটো আর পাপানের যত না ব্যথা লেগেছে, তার চেয়েও ওরা আহত হয়েছে বেশি।
বিনা দোষে একজন লােক ওদের গায়ে হাত দিল? এর আগে কেউ কোনওদিন ওদের
সঙ্গে এরকম খারাপ ব্যবহার করেনি। ওরা কোনওদিন মারই খায়নি।

কলকাতার রাস্তায় এরকম কত কী ঘটে, অন্য কেউ ভুক্ষেপও করে না। কত লােক
হেঁটে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। একদম কাছাকাছি দু-চারজন লােক ওদের
ওরকম ভাবে পড়ে যেতে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল, তারপর চলে গেল যে-যার
নিজের কাজে।

কেউ সেই লােকটিকে একটু বাধাও দিল না, কিছু জিজ্ঞেসও করল না।
টিটো আর পাপান গায়ের ধুলাে ঝেড়ে হতবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল
পরস্পরের দিকে। এটা কী হল? কেন লােকটা এরকম অসভ্যের মতন ব্যবহার করে
চলে গেল ? লােকটা কে?

ব্যাঙ্কের গেটে একজন বন্দুকধারী দরােয়ান থাকে। সে বন্দুকটা পাশে শুইয়ে রেখে
নিশ্চিন্ত মনে খৈনি খাচ্ছে। টিটো তার কাছে গিয়ে বলল, “এইমাত্র যে লােকটি বেরােল
ব্যাঙ্ক থেকে, তাকে আপনি চেনেন? এখানে প্রায়ই আসে?”
দরােয়ান ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, “কোন লােক? কত লােক তাে যাচ্ছে আর
আসছে!”

টিটো বলল, “বেশ লম্বা, খয়েরি সুট পরা।” ।
দারােয়ান বলল, “সুট এখন সবাই পরে। শীত পড়েছে, সুট পরবে না!”
বােঝা গেল, এর কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না।।
পাপান বলল, “আমি গাড়ির নম্বরটা দেখেছি। 9837, তবে আগে কী ছিল? WMF,
না WMB ?
টিটো বলল, “আমি দেখিনি। আর ওকে ধরা যাবে না!”

পাপন চোয়াল শক্ত করে বলল, “ওকে খুঁজে বার করতেই হবে। অকারণে একটা
লােক অন্যায় করে যাবে? ওকে শাস্তি পেতেই হবে! অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে
সহে…’ তুই এই কবিতাটা পড়িসনি, টিটো?”
টিটো বলল, “কিন্তু ওকে খুঁজে পাব কী করে?”
পাপান বলল, “পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, ওকে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব। ওর
মুখটা যেন ভুলে যাস না। দাড়া, একটু চোখ বুজে ওর মুখের ছবিখানা মনে গেঁথে
রাখি।”

টিটো বলল, “ওর মুখটা আমার মনে না থাকলেও, দেখলেই চিনতে পারব।”
তারপর থেকে ওই ব্যাঙ্কের সামনেটায় নজর রাখে দু’ বন্ধুই। যদি সেই লােকটি বা
গাড়িটাকে দেখা যায়। ব্যাঙ্কটার সামনে দিয়ে মাঝে-মাঝে দু’জনেই হাঁটে। অন্য সময়েও
রাস্তার যে-কোনও গাড়ির নম্বরটা ওরা একবার দেখে নেয়। লম্বা-চওড়া, খয়েরি কোটপরা
একজন লােককে পেছন থেকে দেখে পাপান অনেকখানি ছুটে গেল তার মুখটা দেখার
জন্য। সে অন্য লােক।

 


লােকটি আর ব্যাঙ্কে আসে না। রােজ-রােজ কেই-বা ব্যাঙ্কে যায়। তবে পাঁচ দিন
পর অন্য একটি সুযােগ পাওয়া গেল।

পাপান টিকিট কাটতে গিয়েছিল গ্লোব সিনেমায়। হঠাৎ তার নজর পড়ল একটা
গাড়ির নম্বরের দিকে। 9837, তবে আগের অক্ষরগুলাে WMD। আগের অক্ষরগুলাে
মেলাটাই বেশি দরকার, একই নম্বরের অনেক গাড়ি থাকতে পারে। কিন্তু এ-গাড়ির
রংটাও নীল। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে নিউ মার্কেটের সামনে।

যদি এই গাড়িটাই সেই লােকটার হয়? কিন্তু পাপান একা-একা সেই লােকটাকে
দেখতে পেলেই বা কী করবে? কী করে শাস্তি দেবে? টিটোকে একটা খবর দেওয়া
দরকার। টিটোদেরবাড়িতে টেলিফোন আছে।

একটা দোকান থেকে ফোন করল পাপান। টিটো জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিক জানিস
ওটা সেই গাড়ি? নীল রঙের আমবাসাডর গাড়ি তাে কতই আছে!”
পাপান একটু দুর্বলভাবে বলল, “না, একেবারে ঠিক করতে পারছি না। অন্য গাড়িও
হতে পারে। কিন্তু যদি সেই গাড়িটাই হয় ? গাড়িটাকে ফলাে করলে সেই লােকটার
বাড়িটা চিনে আসা হবে।”

টিটো বলল, “ঠিক আছে, তুই নজর রাখ। আমি আসছি!” ।
একটু দূরে, অন্য একটা গাড়ির আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পাপান। টিটোর
আসতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগবেই। তার আগেই যদি লােকটা বেরিয়ে আসে নিউ
মার্কেট থেকে? অতবড় লােকটার সঙ্গে পাপান গায়ের জোরে পারবে না। তবে ছুটে
গিয়ে পেছন থেকে একটা ল্যাং মেরে আছাড় খাওয়াতে পারে। তাতেই অনেকটা প্রতিশােধ
নেওয়া হবে। কিন্তু ওর সঙ্গে যদি অন্য লােক থাকে?

ঠিক তাই। টিটো এসে পৌছবার আগেই নিউ মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল সেই
লােকটি। হ্যা, কোনও ভুল নেই, সেই লােকটাই বটে। তার সঙ্গে রয়েছে আরও দু’জন।
লােক। তারা নীল গাড়িটার দিকেই এগিয়ে আসছে হাসতে-হাসতে। হাতে কয়েকটা
প্যাকেট। পাপানের মনটা দমে গেল। এখনই তাে ওরা গাড়িতে উঠে চলে যাবে, সে কী।
করবে?

লােকটিকে ভাল করে দেখবার জন্য পাপান অনেকটা কাছে এগিয়ে এল।
সেই আসল লােকটাই গাড়ি চালাবে। একটা ভিখিরি বুড়ি জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে
দিল তার কাছে। লােকটা ধমকে উঠল, “এই যা! সরে যা!”
বুড়ি তবু সরে না। ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।

তারপরের ব্যাপারটা দেখে আঁতকে উঠল পাপান। লােকটা সাঁ করে কাচ তুলে দিল
গাড়ির জানলার। তাতে আটকে গেল ভিখিরি বুড়িটার হাত। বুড়িটা যন্ত্রণায় চিৎকার
করে, “ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে’ বলতে লাগল, আর ভেতরে সেই লােকগুলাে
খলখল করে হাসছে।

ঠিক এই সময় টিটো এসে ডাকল, “পাপান!”
কাছেই একটা ট্যাক্সি থেমেছে, তার মধ্যে বসে আছে টিটো। পাপান দৌড়ে এসে
ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বলল, “সেই গাড়ি, সেই লােক। ওকে ফলাে করে বাড়িটা দেখে
আসতে হবে।”

 

জানলার কাচ আবার নামিয়ে নীল গাড়িটা এবার স্টার্ট দিয়েছে।
পাপান উওেজিতভাবে বলল, “ওই লােকটা, ওই লােকটা, ওর মতন খারাপ লােক
আমি পৃথিবীতে আর দেখিনি। একটা ভিখিরিকে শুধু-শুধু কী কষ্ট দিল ! ওকে ছাড়া হবে
, ওকে শাস্তি দিতেই হবে!”

টিটো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, “আপনি আবার চলুন, শিগগির!”
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “কোন দিকে যাব?”

টিটো আর কিছু বলবার আগেই পাপান বলল, “ডান দিকে ঘুরিয়ে নিন।
সে একটা গল্পের বইয়ে পড়েছে যে, অল্প বয়সী ছেলেরা কোনও ট্যাক্সিতে চেপে
অন্য কোনও গাড়ি ফলাে করতে বললে ট্যাক্সি-ড্রাইভাররা সন্দেহ করে। যেতে চায় না।
সেইজন্য পাপান শুধু আগের গাড়িটা দেখে-দেখে বলতে লাগল, “ডান দিকে, এবার
বাঁ দিকে।”

বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর টিটো ফিসফিস করে বলল, “গাড়িটা কত
দূর যাবে রে? ট্যাক্সিভাড়া অনেক হয়ে গেলে কী করে দেব? আমার কাছে বেশি পয়সা
নেই। তাের কাছে আছে?”

পাপান বলল, “আমার কাছে তাে পাঁচ টাকার বেশি নেই!”
টিটো বলল, “এর মধ্যেই পনেরাে টাকা উঠে গেল, আমার কাছে আছে মাত্র দশ
টাকা।”
পাপান বলল, “একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। এখন আর ওকে ছাড়লে চলবে না।

নীল গাড়িটা এসে থামল টালিগঞ্জে, বড় রাস্তা ছেড়ে একটা ছােট রাস্তায় ঢুকে
একটা পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির সামনে। পাপান আর টিটো নেমে পড়ল একটু দূরে। ট্যাক্সি
ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ওরা ঠিকানা খোঁজার ভান করে একটু-একটু
করে এগােতে লাগল।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এ-রাস্তাটা অন্ধকার অন্ধকার মতন। সেই বাড়িটার সামনে
একটা লােহার গেট, ভেতরে একজন দারােয়ান বসে আছে। লােক তিনটে ভেতরে
ঢুকে গেছে, ভেতরটায় কিছু দেখা যাচ্ছে না।

এ তাে বেশ বড়লােকের বাড়ি। এখন কী করা যায়?
পাপান ভাবল, লােকটা এমন বড়লােক হয়েও একটা বুড়ি ভিখিরিকে অমন কষ্ট
দেয় ? পাষণ্ড! ওকে শাস্তি দিতেই হবে!

_ বাডিটার সামনে এমনই ঘােরাঘুরি করা যায় না। ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছে। পাপান
ঠিক করে ফেলেছে যে, ওই ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরতে হবে, না হলে ভাড়া দেবে কী
করে? বাড়িতে গিয়ে দাদার কাছে টাকা চাইতে হবে। দাদা যদি এখন বাড়িতে না থাকে,
তা হলে মায়ের কাছে!

টিটো বলল, “এখন আর তাে কিছু করার নেই। বাড়িটা তবু চেনা হল।”
পাশ থেকে গায়ে চাদর জড়ানাে একটি লম্বামতন ছেলে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের
কী চাই ভাই? কাকে খুঁজছ?”

 

টিটো বলল, “কিছু চাই না। একটা ঠিকানা খুঁজছি। আমার এক বন্ধু থাকে পঁয়তাল্লিশ
নম্বর বাড়িতে, কিন্তু সে তাে ওরকম লােহার গেটওয়ালা বাড়ি বলেনি, এমনই সাধারণ
দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িটা কার বলতে পারেন?
লম্বা ছেলেটি বিরক্ত ভাব করে বলল, “ওটা তাে রঘু চৌধুরীর বাড়ি। কেন, তার
সঙ্গে তােমাদের কী দরকার?”

পাপান বলল, “না, না, কোনও দরকার নেই। এমনই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
ছেলেটি বলল, “মহা-পাজি লােক! লােককে ঠকিয়ে-ঠকিয়ে অত বড় বাড়ি করেছে।
এটা আগে ছিল একজন বিধবা ভদ্রমহিলার, তিনি হঠাৎ মারা গেলেন। তারপর বাড়িটা
রঘু চৌধুরীর হয়ে গেল। লােক বলে, ওই রঘু চৌধুরীই বিধবা মহিলাকে বিষ খাইয়ে
মেরে ফেলেছে!

টিটো চোখ বড়-বড় করে বলল, “খুন? ওকে পুলিশে ধরেনি?”
ছেলেটি বলল, ‘ওর সব বড়-বড় লােকের সঙ্গে চেনা আছে। কী সব কলকাঠি
নেড়েছে, কেউ ওকে ছুঁতেও পারেনি!”
টিটো আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনারা পাড়ার লোেক কিছু করতে পারেননি ?
ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল না?”

ছেলেটি বলল, “ওকে ধরা-ছোঁওয়া অত সহজ নয়। আমরা কিছু করতে গেলে
আমাদেরই পুলিশে ধরিয়ে দেবে। জানাে, আমি ওর কাছে একবার চাকরি চাইতে
গিয়েছিলাম। আমার কথা ভাল করে শুনলই না, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল, কুকুর
লেলিয়ে দিল!”

ট্যাক্সিওয়ালা অধৈৰ্য্য হয়ে গেছে, ওদের উঠে পড়তে হল। ফেরার পথে আগাগােড়া
গম্ভীর হয়ে রইল পাপান।

এর পর দু-তিনদিন দুই বন্ধু দেখা হলেই ওই রঘু চৌধুরীকে নিয়ে আলােচনা করে।
লােকটা অসভ্য, নিষ্ঠুর, খুনি, অথচ তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারে না! একটা খারাপ
লােক মানুষের ক্ষতি করে ঘুরে বেড়াবে, এত বড় বাড়িতে থাকবে, অথচ কেউ জানতে
পারবে না তার আসল রূপটা? একটা কিছু করতেই হবে, কিন্তু কী করা যায় ?
ওরা দু’জন মাঝে-মাঝে চলে আসে টালিগঞ্জে।

সেই বাড়িটার সামনে ঘােরাঘুরি
করে। দু-একবার রঘু চৌধুরীকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে। একবার রঘু
চৌধুরীর সঙ্গে পাপানের চোখাচোখিও হয়ে গেল। কিন্তু রঘু চৌধুরী তাকে চিনতেও
পারল না। ও নিশ্চয়ই অনেক, অনেক লােকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, তাদের
মুখ মনে রাখতে পারে না।

ওরা খবর জোগাড় করল যে, রঘু চৌধুরী এ-পাড়ার দুর্গাপূজো, কালীপুজোর সময়
অনেক টাকা চাদা দেয়। তাই কেউ তাকে ঘাঁটায় না। তবে একটা চায়ের দোকানের
সামনে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে বলছিল, রঘু চৌধুরী আসলে স্মাগলার, তাই ওর এত টাকা !
একদিন সকালবেলা ওই বাড়ির লােহার গেটের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওরা দেখল,
ভেতরে একটা সুন্দর সবুজ লন।

সেখানে দুটি ফুটফুটে ছেলে, পাপানদের চেয়ে অনেক
ছােট। মনে হয় ক্লাস ফোর আর ফাইভে পড়ে, একটা বল নিয়ে খেলছে, আর তাদের
সঙ্গে খেলায় যােগ দিয়েছে রঘু চৌধুরী আর একটা কুকুর। বাবা ছেলেদের সঙ্গে খেলছে
আর সবাই মজা করে হাসছে। এক-একবার ছােট ছেলেটাকে কাধে তুলে নিচ্ছে রঘু।
চৌধুরী। কুকুরটা লাফাচ্ছে পাশে।

কী সুন্দর দৃশ্য ! মনে হয় কী আনন্দময় এই বাড়ি। রঘু চৌধুরী তার ছেলেদের সঙ্গে
এত ভাল ব্যবহার করে, আর খুব খারাপ ব্যবহার করে বাইরের লােকদের সঙ্গে।
সেদিন ফেরার পথে টিটো বলল, “আর টালিগঞ্জে এসে কী হবে রে পাপান? কিছুই
তাে করা যাবে না!”

পাপান বলল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।”
টিটো সঙ্গে-সঙ্গে উৎসুকভাবে বলল, “কী?”
পাপান বলল, “ওকে বেনামী চিঠি লিখব! ওপরে একটা মানুষের মাথার খুলি
এঁকে লিখব, সাবধান রঘু চৌধুরী! তুমি যদি পাপ কাজ বন্ধ না করাে, তা হলে তােমার
মুণ্ডু উড়ে যাবে! ইতি মেঘনাদ! মেঘনাদের তলায় একটা জ্বলন্ত তীর আঁকা থাকবে!”
টিটো বলল, “এই চিঠি পেলে ও হাসতে-হাসতে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে
দেবে! মােটেই ভয় পাবে না।”

পাপান বলল, “কেন ভয় পাবে না? তুই কী করে জানলি ওদের বাড়িতে ওয়েস্ট
পেপার বাস্কেট আছে?”
টিটো বলল, “সব বাড়িতেই থাকে। শুধু চিঠি পড়ে ভয় পাবে কেন? মুণ্ডু ওড়াবার।
ক্ষমতা যে তাের আছে, তার কোনও প্রমাণ দিতে পারবি?”
পাপান বলল, “আরও বেশি ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখব!”
টিটো বলল, ‘দ্যুৎ ! ওতে কিছু হবে না। অন্য রাস্তা ভাব।”

পরদিন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে না গিয়ে টিটো দৌডে-দৌড়ে চলে এল পাপানের
বাড়িতে। ছাদে টেনে নিয়ে গেল। তারপর দারুণ উত্তেজিত ভাবে বলল, “আজ ইস্কলে
কী দেখলাম জানিস! ওই ছেলে দুটো আমাদের ইস্কুলেই পড়ে!”
“ওই ছেলে দুটো মানে?”

“রঘু চৌধুরীর দুই ছেলে। ওদের নাম অজয় আর সুজয়। আমাদের জয়দেবের ভাই
গােগাে ওই সুজয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। গােগাে বলল, ওরা দুই ভাই-ই খুব ভাল।
পড়াশােনায় ভাল, ব্যবহারও খুব ভদ্র! ওই নীল গাড়িটা ছুটির পর ওদের নিতে আসে।”
“তা হলে তাে খুব কাছাকাছি এসে গেল রে!”

 “রঘু চৌধুরীও হয়তাে কোনওদিন স্কুলে আসবে। তারপর ওকে পেছন থেকে ল্যাং।
মারব?” “তার চেয়ে অনেক কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা আমার মাথায় এসে গেছে। শােন
টিটো, মনে কর, তুই একদিন জানতে পারলি যে, তাের বাবা একজন চোর কিংবা
খুনি-

“অ্যাই, কী হচ্ছে কী? আমার বাবা কীরকম লােক, সবাই জানে।”
“আহা, সত্যি-সত্যি বলছি না! ধর, যদি এমন হত! তাের কিংবা আমার বাবাকে
সবাই খুব ভাল লোেক বলেই জানে, হঠাৎ একদিন প্রমাণ বেরিয়ে গেল বাবা একজন
খুনি, তা হলে তাের মনের অবস্থা কী হত?”
“বাবাকে আমি ঘেন্না করতাম।”

“ঠিক তাই। রঘু চৌধুরী লােকটা তাে সত্যিই খারাপ! ওর ছেলে অজয় আর সুজয়
তা জানে না। ওরা বাবাকে ভালবাসে। ওদের আমরা সব কথা জানিয়ে দেব। প্রমাণ
দেব। তখন ওরা বাবাকে ঘেন্না করতে শুরু করবে। সেটাই হবে রঘু চৌধুরীর শাস্তি।”

“গুড আইডিয়া, কিন্তু…”
এর মধ্যে আবার কিন্তু কী ?”

‘অজয় আর সুজয় অত ছােট… বাবা সম্পর্কে হঠাৎ ওইসব জানতে পারলে ওদের।
মনে খুব আঘাত লাগবে না ? ওদের তাে কোনও দোষ নেই! অন্য কিছু করা যায় না,
পাপান ?”

“অন্য আর কী?”
টিটো পাপানের কাছে মাথাটা নিয়ে এসে বলল, “তুই যে সেই চিঠির কথাটা
বলেছিলি?’

‘ দু’জনে বুদ্ধি আঁটল অনেকক্ষণ ধরে।
পরদিনই রঘু চৌধুরী তার বাড়ির লেটার-বক্সে একটা চিঠি পেল। সাদা খাম। ভেতরে
একটা সাদা পাতায় গােটা-গােটা অক্ষরে লেখা :

“রঘু চৌধুরী, সাবধান!
তােমার পাপের কথা,
কুকীর্তির কথা সব বলে দেব
তােমার দুই ছেলেকে!
ইতি মেঘনাদ”

চিঠিটা পড়ে রঘু চৌধুরীর ভুরু কুঁচকে গেল। কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলল বটে,
কিন্তু সারাদিন তার মনটা খচখচ করতে লাগল।
পরদিন আর-একটা চিঠি :

“রঘু চৌধুরী, সাবধান!
তােমার ছেলে অজয় সুজয়।
কোন ইস্কুলে যায়, আমরা জানি
তােমার বহু পাপের প্রমাণ আছে
আমাদের হাতে
অজয় আর সুজয়কে জানিয়ে দেব
সব কথা, সব কথা
লজ্জায় তাদের মাথা হেট হয়ে যাবে!
ইতি মেঘনাদ”

এবারে চিঠিটা ছিড়তে গিয়েও ছিডল না রঘু চৌধুরী। ভাজ করে পকেটে রেখে
দিল। সারাদিন কাজের ফাকে-ফাকে চিঠিটা পড়তে লাগল বারবার। তার বুক ঢিপঢিপ
করছে। জীবনে সে কখনও এত ভয় পায়নি। নিজের ছেলে দুটিকে সে সত্যিই খুব
ভালবাসে।
এবার এল তিন নম্বর চিঠি :
“রঘু চৌধুরী, সাবধান!

আর সময় নেই
তুমি চাও তােমার ছেলেরা তােমায়
ঘেন্না করুক?
সব বলে দেব, সব!
এখনও যদি বাঁচতে চাও
কাল সকাল সাতটায় দেখা করাে
বিবেকানন্দ পার্কে বড় ছাতিম গাছের তলায়
ইতি মেঘনাদ
পুঃ : একা আসবে!”

এবারে রঘু চৌধুরী ধরে নিল, যে তাকে ভয় দেখাচ্ছে, সে টাকা চায়। ব্ল্যাকমেইল!
তার মুখখানা হিংস্র হয়ে উঠল, চিঠিখানা টুকরাে-টুকরাে করে পা দিয়ে মাড়িয়ে সে
ড্রয়ার খুলে বার করল একটা রিভলভার!

পরদিন ঠিক সকাল সাতটায় রঘু চৌধুরী বিবেকানন্দ পার্কে এসে হাজির। বড়
ছাতিম গাছটার কাছে এসে সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সেখানে বসে আছে একটা
তেরাে-চোদ্দ বছরের হাফপ্যান্ট-পরা রােগা ছেলে, তাকে সে পাত্তা দিচ্ছে না। তার
ধারণা, কোনও বিকট চেহারার গুণ্ডা লুকিয়ে আছে কাছেই। পকেটে হাত দিয়ে সে
চেপে ধরে আছে রিভলভারটা।

পাপান হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, “এই যে চৌধুরীমশাই, এদিকে আসুন! আমিই
মেঘনাদ!”

রঘু চৌধুরীর মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “হতভাগা
ছেলে! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? মেরে তাের মুখের সব ক’টা দাঁত ফেলে দেব!”
একটুও ভয় না পেয়ে পাপান বলল, “আমাকে ওরকম শাসাবেন না, কোনও লাভ
নেই। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আমার বন্ধুরা। আপনি আমার ওপর আক্রমণ করতে
এলেই তারা এসে ঝাপিয়ে পড়বে! একজন পুলিশে খবর দেবে। তাতেই তােমার দুই
ছেলে সব জেনে যাবে!”

থমকে গিয়ে রঘু চৌধুরী বলল, “তুই কী চাস? কত টাকা?”
পাপান হা-হা করে হেসে উঠল।

রঘু চৌধুরী বলল, “শােন, আমি তােকে এক হাজার টাকা দেব। তারপর খবরদার
আমার ছেলেদের কাছে ঘেঁষবি না। যদি ওদের কিছু বলতে যাস, তোকে খুন করে
ফেলব। নির্ঘাত খুন করে ফেলব!”

পাপান বলল, “আমাকে খুন করলেও আমার অন্য বন্ধুরা থাকবে। তারা তােমার
ছেলেদের বলে দেবে, তুমি খুনি, তুমি স্মাগলার, তুমি বিনা কারণে অন্য ছেলেদের ধাক্কা
মেরে মাটিতে ফেলে দাও! এইসব শুনে তােমার ছেলেরা তােমাকে ঘেন্না করবে। তােমাকে
বাবা বলে মানতে চাইবে না।”

রঘু চৌধুরী এক পা এগিয়ে এসে বলল, “তুই কত টাকা চাস?”
পাপান বলল, “এক পয়সাও চাই না। তােমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। যদি ক্ষমা না
চাও…”

রঘু চৌধুরীর শরীরটা কেঁপে উঠল। সমস্ত মুখটা কুঁচকে গেল। হঠাৎ সে মাটিতে
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, “ক্ষমা চাইছি! আর কক্ষনাে এসব করব না! কাউকে
ঠকাব না, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। তুমি আমার ছেলেদের কিছু বােলাে
না। ওরা আমাকে এত ভালবাসে, বলাে না, প্লিজ, কিছু জানিয়ে দিয়াে না ওদের, আমি
এখন থেকে আর কোনও অন্যায় করব না।”
বলতে-বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রঘু চৌধুরী।

সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments