বন্ধু (প্রথম পর্ব) || BONDHU FRIST PART ||



বন্ধু (প্রথম পর্ব)


মাঝরাতে ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল তিথির। ঘুম চোখে ফোনটা ধরতে গিয়ে দেখল ঘড়িতে রাত দুটো। অচেনা নম্বর, ........ এতো রাতে!! .......তাও ফোনটা ধরে তিথি।

-"তোমার মেসোমশাই কেমন করছেন ঘুমের ভেতর। ডক্টর বেরা ফোন তুলছেন না। কি করবো এখন ?"

গলাটা কেমন জড়ানো। তবে ডক্টর বেরা শুনে ঘুম চোখেও বুঝতে পারল ফোনের ও প্রান্তে রয়েছেন রমা দেবী। সাথে সাথে ঘুম কেটে যায়। -"আমি এখনি আসছি । চিন্তা করবেন না মাসিমা, আমার আধ ঘণ্টাও লাগবে না। " বলে ফোনটা কেটেই ঋজুকে ফোন করে তিথি। কাছেই ওদের বাড়ি। ওকে সব বলে তৈরি হতে বলেই ওলার খোঁজে মোবাইলে চোখ রাখে।দশ মিনিটে পাবে দেখেই বুক করে, ফটাফট তৈরি হয়ে নিচে নামে। এত রাতে বৌদিকে ডেকে কিছু বলতে গেলে আরও দেরি হবে। দাদার নাইট চলছে। কাজের মাসিকে ডেকে একটু বুঝিয়ে বলে বেরিয়ে আসে। গাড়ীও এসে যায় তক্ষুনি। বড়রাস্তা থেকে ঋজুকে তুলে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ী ছুটে চলে গড়িয়াহাটের দিকে।

আজ একবছর ধরে এই পরিবারটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছে তিথি। রমা দেবীর স্বামী মলয় বাবু ছিলেন সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার। দুটি ছেলেই আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা, এক মেয়ে লন্ডনে থাকে। বৃদ্ধ বৃদ্ধা বাড়ি আগলে পড়ে রয়েছেন এই কলকাতায়। ঋজু ততক্ষণে ডক্টর বেরাকে না পেয়ে আরেকজন ডক্টরকে ফোনে বাড়ির ঠিকানা বোঝাচ্ছে। সারা কলকাতার বেশ কিছু ডক্টর ওদের এই কার্যকলাপের সাথে পরিচিত, তাদের রাতেও পাওয়া যায় প্রয়োজনে।

 

মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেল ওরা। পাঁচ মিনিটে ডক্টর সেন ও এসে গেলেন। কিন্তু মলয়বাবুর ম‍্যাসিভ্ অ্যাটাক হয়েছে,তক্ষুনি হাসপাতালে দিতে বললেন ডঃ সেন। বাইপাসের ধারে একটা বেসরকারি হাসপাতালে তক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে ঋজু আর ডঃ সেন বেরিয়ে গেলেন।তিথি রয়ে গেল রমা দেবীর কাছে , ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটা।

রমা দেবী কেমন ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিথি ডঃ সেনের পরামর্শে ওনাকে একটু ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছিল। উনিও প্রেশার আর সুগারের রুগী। উনি নানারকম কথা বলছিলেন। এক ফাঁকে ওনার বড় ছেলেকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল তিথি। সে বোন ও ভাইকে জানাবার দায়িত্ব নিয়েছিল বলে আর ফোন করতে হয় নি। রমা দেবী নিজেই নিজের ভাইয়ের ছেলেকে জানিয়ে ছিলেন। তারা হাওড়ায় থাকে। এতো রাতে আসতে পারেনি।

 

ঋজু ওনাকে ভর্তি করে ফোন করেছিল, আপাতত ওষুধ ইনজেকশন্ দিয়ে আই সি-ইউতে রাখা হয়েছে ওনাকে। কাল সকালে স্পেশালিষ্ট ডক্টর দেখবেন। এনজিওগ্ৰাফি করা হবে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেছিলেন রমা দেবী।

 

সকালে আজ তিথির সহেলী দেবীকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার কথা ছিল। মিলিকে ফোনে বুঝিয়ে বলল কাজটা করে আসতে। মিলির আজ অফ্ ছিল সকালটা। বৌদিকে ফোন করে বুঝিয়ে বলল সব।

ঋজুর আজ সকাল দশটায় একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট ক‍্যানসেল করতে হল।পর্না বৌদি তার তিন বান্ধবীকে নিয়ে বাকি গুলো ম‍্যানেজ করে নেবে বলল। বাবুয়ার শরীরটা খারাপ, ছুটি নিয়েছিল। ওকে সব জানানোয় ও এসে যাবে বলল।

এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসল তিথি। কলকাতার ঘুম ভাঙ্গছে ধীরে ধীরে............।।

প্রথম আইডিয়াটা তিথির মাথাতেই এসেছিল। ঋজু, কাজল, বাবুয়া আর মিলিকে ডেকে একদিন আলোচনা করেছিল বিষয়টা নিয়ে। কাজল একটুও রাজি হয় নি। ঋজু বলেছিল ভাল আইডিয়া,, কিন্তু কতদূর কাজ হবে জানি না। আর মিলি বলেছিল প্রচুর ঝামেলা আছে। আমাদের দিয়ে হবে না। একমাত্র বাবুয়াই কোনও প্রশ্ন না করে মন দিয়ে শুনে বলেছিল,দেখা যেতেই পারে। তবে আরও লোক দরকার।

তিথি, ঋজু, কাজল, মিলি আর বাবুয়া ছোটবেলার বন্ধু। পড়া শেষ করে সবাই তখন চাকরী খুঁজছিল আর সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিল। একটা কাগজে এমন সংস্থার কথা পড়ে আর নেট ঘেঁটে আইডিয়াটা তিথির মাথায় এসেছিল। বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে বাড়ি ফিরে প্রথমে বৌদিকে খুলে বলেছিল নিজের পরিকল্পনা। বৌদি কিন্তু খুব উৎসাহ দিয়েছিল ব‍্যপারটা শুনে।অবশেষে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় তারা আরও কয়েকজনকে নিয়ে এই ছোট্ট সংস্থাটা খুলেছিল, নামটা তিথির দেওয়া "বন্ধু"।আস্তে আস্তে ভালই দাঁড়িয়ে গেছিল ওদের ছোট্ট সংস্থা। সবাই সুন্দর ভাবে সবদিক সামলে চলছিল।

বিপবিপ করে তিথির মোবাইল ফোনটা বাজছিল।তুলতেই ও পাশের থেকে মহিলা কণ্ঠ জানতে চাইল -"বন্ধু ? "

-"বলছি, বলুন? কি সাহায্য করতে পারি ?" তিথি গলায় মিষ্টতা এনে বলে।

-" আপনারা কি ধরনের পরিষেবা দিয়ে থাকেন? আর কোথায় কোথায় ?"

-"আমরা প্রবীণ দের সাহচর্য দেই। তাদের সাথে সময় কাটানো, প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা, ডক্টর দেখানো, কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, ব্যাঙ্ক পোস্টঅফিসের কাজ করে দেওয়া, মন্দিরে বা আত্মীয়দের বাড়ি নিয়ে যাওয়া,সব রকম সাহচর্য পাবেন কলকাতার সব জায়গায়। " 

-"দেখুন, আমি বাইরে থাকি। আমার মা কে দেখার জন্য একজন লোক চাই।"

-"আমরা ঠিক ২৪ঘন্টার লোক মানে আয়া বা নার্স দেই না। অবশ্য আপনাকে ভাল ঐ ধরনের সংস্থার নম্বর দিতে পারি। আমরা স্বল্প সময়ের পরিষেবা দিয়ে থাকি।"

-"আমি জানি না সেন্টারের আয়ারা কতটা সুরক্ষিত !! এক পরিচিত আপনাদের নম্বর দিয়েছিল। তাই অনেক আশা নিয়ে ফোন করেছিলাম "

-"না, আপনি যেমন চাইছেন আপাতত তেমন ব্যবস্থা নেই, ধন্যবাদ" ফোনটা কেটে দেয় তিথি।

 

এই হয়েছে মুশকিল। স্বল্প-কালীন পরিষেবা বিষয়টা অনেকেই বোঝে না, আবার অনেকে কটাক্ষ করে এই সব কিছুও পয়সা দিয়ে কিনতে হবে বলে।আবার কিছু লোক এগুলোর অন্য মানে বার করে নোংরামো করতে চায়।

তিথিদের প্রথম ক্লায়েন্ট ছিল সল্ট-লেকে। ওদের ওয়েবসাইট দেখে প্রথম ফোনটা করেছিলেন রিটায়ার্ড আইনজীবী মিঃ দত্ত। তিথি আর ঋজু গেছিল দেখা করতে। উনি পুরো ব‍্যপারটা শুনে ওনার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের বশে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন।

প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন -"আমার বাড়ির সব খবর জেনে কাল যে আমার বাড়ি তোমাদের পরিচিত লোক দিয়ে ডাকাতি বা ঐ জাতীয় কিছু করবে না, তার গ‍্যারেন্টি কি? অথবা আমাদের বুড়োবুড়ির অন্যমনস্কতার সুযোগে বাড়িতে ছিঁচকে চোর ঢোকাবে না ? তাছাড়া মেয়ে পাঠিয়ে আমাকে অন্য কোনও কেসে ফাঁসাতে পারো ? ...."

তিথির কান লাল হয়ে গেছিল। উঠেই পড়েছিল চলে আসবে বলে। ঋজু টেনে বসিয়েছিল । বলেছিল -" আপনি যেগুলো বললেন সব সত্যি, আপনার বাড়ি কি কাজের লোক রান্নার লোক আছে ? এগুলো তো তারাও করতে পারে। তবুও সবাই কাজের লোক রাখে। অসুস্থ হলে নার্স বা আয়া ও লাগবে, অথচ ভরসা করতে হবে যে কোনও সেন্টারের উপর। সেন্টারের আয়া বা কাজের লোক ২৪ঘন্টার জন্য রাখতে পারবেন অথচ আমাদের সংস্থা নতুন বলে ভরসা করতে পারছেন না। আমদের ওয়েবসাইটে আমাদের সব তথ্য দেওয়া আছে। পালিয়ে যাব না এটুকু বলতে পারি। কেউ না কেউ তো আমাদের প্রথম ক্লায়েন্ট হবেই।" একসাথে কথা গুলো বলে একটু থেমেছিল ঋজু।

-" তোমার কথা গুলোয় যুক্তি আছে। মানছি। একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাদের। আমার দুই ছেলেই বিদেশে। বাড়ি আসবে না কোনও দিন। আমার স্ত্রী অসুস্থ। শারীরিক অসুখের ওষুধ ডক্টর দিচ্ছেন, কিন্তু মনের অসুখ কি করে সারবে !! আত্মীয়দের সময় নেই। তোমরা যদি সপ্তাহে তিনদিন করে এসে ওনার সাথে সময় কাটাও ........ ওর একাকীত্ব হয়তো কাটবে। তবে পরিচয় দেবে আমার বন্ধুর মেয়ে বা ছেলে বলে। তোমরা দুজনেই আসবে নাকি অন্য কেউ আসবে?"

-"আপাতত আমরা দুজনেই আসব, হয় ও নয় আমি। " খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিল ঋজু।

-"তোমাদের পেমেন্ট টা ......" মিঃ-দত্তকে থামিয়ে ঋজু বলেছিল সব সাইটে দেওয়া আছে। আগে আসি, তারপর ওটা নিয়ে কথা হবে।"

সেদিন ওদের নিয়ে গিয়ে মিসেস দত্তর সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন মিঃ-দত্ত। বলেছিলেন -" আমার এক বন্ধুর ছেলে আর ওর বান্ধবী এখানে পাশেই একটা ক্লাসে এসেছিল। ওদের বলেছি মাঝেমধ্যে এসে আমাদের একটু সঙ্গ দিতে। "

মিসেস দত্ত শুধু চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। সেই চোখে কোনও অনুভূতি ছিল না।

আজ একবছর পর মিসেস দত্ত সাগ্ৰহে ওদের পথ চেয়ে বসে থাকেন। নিজে হাতে মাঝেমধ্যে জলখাবার বানান ওদের জন্য। দুবার বেলুড় মঠ ঘুরিয়ে এনেছে ঋজু। তিথি ভাল বাংলা সিনেমার সিডি নিয়ে যায় কখনো। একবার সিটি-সেন্টার 'প্রাক্তন' দেখিয়ে এনেছে।(চলবে)

Post a Comment

0 Comments