গোধূলি রঙ ||



গোধূলি রঙ




"কানটা ছাড়ো সুনিতা শুভমের।একবার শোন এদিকে।"

'হ্যাঁ বলুন ম্যাডাম।'

''তুমি ঐ ভাবে শুভমকে মারছিলে কেন?''

'দেখুন না ম্যাম, প্যাস্টেল রঙ দিয়ে দেওয়ালে একটা হাতি এঁকে দেওয়ালটাকে কিভাবে

নষ্ট করেছে।'

'' তো কি হয়েছে!এটা কি তোমার আমার বাড়ির ড্রয়িং রুম যে শোপিস্ দিয়ে সাজানো

থাকবে?এটা তো স্কুল, আর ক্লাসরুম গুলো তো ওদের জায়গা।যতক্ষণ না ভাঙচুর করে কিছু

নষ্ট করছে সেখানে তো কিছু বলার নেই।একটা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা নতুন ছবি আঁকতে

শিখেছে ওতো সেখানে আঁকবেই।ফারদার আর এই ভাবে শাসন করবেনা।মুখে আদর করে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করবে।হ্যাঁ আর শোন আমার কথা তোমার হয়তো খারাপ লাগল কিন্তু

তোমারতো বাচ্চা আছে ভেবে দেখো।''

' ম্যাম বাড়ি যাবেন না?'

ঘুরে ঘুরে ক্লাসরুম গুলো দেখতে দেখতে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিলেন

মণিদেবী।35 বছর একভাবে এই ছোট্ট গ্রামটার স্কুলে আছেন মণিদেবী।আজ বিদায় বেলায়

অনেক ঝাঁপি যেন উপুড় হয়ে উপছে পড়েছে তার মনের দরজায়। হঠাত্‍ করে সহকর্মীদের ডাকে আবার বর্তমানে ফিরে এলেন।

''হ্যাঁ যাবো।কিছু কাজ তো বাকি, শেষ করে যাবো।তোমরা এসো।সবাই ভালো থেকো।অনেক বকা ঝকা করেছি দিদিভেবে মনে ক্ষোভ রেখো না।''

সকলেই একে একে প্রণাম করলো।'আপনি তো কিছুই নিলেন না উপহার।গাড়ির ব্যবস্থাও

করতে দিলেন না।'-একজন সহকর্মী কুন্ঠিত ভাবে বললেন।

মণিদেবী মৃদু হেসে ওদের সকলের হাত ধরে বললেন-''পাগল গুলো এত স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি

যে এর ভার বইতেই হাঁপিয়ে উঠবো।আর এর থেকে বড় উপহার লাগবে না।''

সকলে বিদায় নিয়ে একে একে বেরিয়ে গেল।

বাগানের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন মণিমালা।35বছর আগে যখন স্কুলে এসেছিলেন চিরকাল

শহরে বেড়ে ওঠা মণিমালা গ্রামের টিনের চালের স্কুলটা দেখেই হতাশায় মুষড়ে

পড়েছিলেন।তারপর তো কত পথ পার হলেন।স্কুলটা যে কবে তার আর একটা ঘর হয়ে উঠলো

নিজেও টের পেলেন না।40 বছর বয়সে প্রধান শিক্ষিকার পদ পেলেন।প্রথম থেকেই

মণিমালা দেখেছে আদিবাসি ছেলেমেয়ে গুলো গরীব হলেও বড়ো সরল।আর কি অদম্য

সংগ্রামের মধ্যে তাদের পড়াশোনা।ওদের দুষ্টূমি,ভালোবাসা,হাসি,  কান্না মণিমালাকে কবে যেন ওদের মায়ের আসনে বসিয়ে দিয়েছে।তার স্বভাব গাম্ভীর্য ভেঙে একমাত্র আপন প্রাঙ্গন,মুক্ত আকাশ ছিল মণিমালার ঐ ক্লাসরুম গুলো।

বাগানের কোনের পলাশ ফুল গাছটা লাল রঙে রক্ত ঢেলে দিয়েছে।সূর্য এই গাছটা যেদিন

এনে আধো আধো স্বরে আব্দার করেছিল বসাবে বলে।মণিমালা তো হেসেই খুন।তার প্রশয়ের

হাসি দেখেই দুষ্টুটা ছুটে গিয়ে বাগানের কোনে গাছটা বসিয়ে দিয়েছিল।মণিমালা খেয়াল করতো, রোজ জল দিত সূর্য গাছটাতে।জানে না সূর্য আজ কোথায় গাছটা কিন্তু আজো

রয়েছে।প্রত্যেকটা ক্লাসরুমে বাচ্চাদের গন্ধ।দেওয়াল গুলো দুষ্টুগুলোর ছবি,লেখায় ভরে রয়েছে। চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠলো। চশমাটা খুলে মুছে নিলেন।

35 বছর আগে সদ্য স্কুলে চাকরি পেয়েছে মণিমালা।স্কুলে পড়ার সময় থেকেই শুভময়

মণিমালার কাছের বন্ধু।কবে যেন কাছের ভালোবাসার মানুষটাও হয়ে উঠলো।দুজনেই চাকরি

পাওয়ার পরেই দুই বাড়ির মধ্যে বিয়ে নিয়ে কথা বার্তা শুরু হলো।কিন্তু অকাল কালবৈশাখি নেমে এল জীবনে।সুস্থ সবল মার হঠাত্‍এক রাতে মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা।তারপর ছয়মাস শুধু হসপিটাল আর বাড়ি।শেষ রক্ষা হয় না।মা বিদায় নেয়।মা চলে যাবার পর থেকে মণিমালার বাবা হয়ে ওঠে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত।স্কুল সামলে বাবাকে সামলে রাখতে রাখতে মণিমালার মন থেকে বিয়ের চিন্তা অনেক দূরে চলে গেছে।কিন্তু শুভময় দের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসতে থাকে।মণিমালার তখন বাবাকে ছেড়ে বিয়ে করবার মানসিক অবস্থা ছিল না।

মণিমালা অগত্যা ওদের ওয়েট করতে না পারলে অনত্র্য বিয়ে করার কথা জানায়।কুড়ি

বছরের সম্পর্ক ভেঙে কার্যকরী হতে দুই মাসও সময় লাগে না।এক সকালে বিয়ের কার্ড

হাতে আসে মণিমালার।দুঃখের অনুভুতি টুকু বোঝার সময় মণিমালার ছিল না সেই

সময়।মণিমালা ততদিনে ছোট ছোট প্রাণ গুলোর মাঝে ওর বাঁচার আশ্রয়টা খুঁজে পেয়ে

গিয়েছিল।

কিন্তু আজ যেন বড় একা লাগছে, শূণ্য লাগছে বুকের কাছটায়।কোথায় যাবে এবার মণিমালা

এই জগত্‍ সংসারে তো আর কেউ নেই ওর।এতদিন এই স্কুলের হাসি,কান্না,ভালোবাসা,দুষ্টুমির মাঝে সেই কথাটা ভাবার অবকাশ পাননি।কোনো একাকিত্ত্ব,শূণ্যতা তাকে গ্রাস করেনি।

হঠাৎ পায়ে তে একটা হাতের স্পর্শে চমক ভাঙলো মণিমালার।শিবশরণ মণিমালার প্রাক্তন

ছাত্র।প্রায় 25 বছর আগে. রোল নং 5. 'আসেনি ম্যাম।'

''এই নিয়ে 15দিন কামাই ।ও কেন আসছে না জানিস কিছু?''

'হ্যাঁ ম্যাম জানি।ও তো আর আসবে না।স্টেশনের চায়ের দোকানে কাজে লেগেছে।'মনটা

খারাপ হয়ে গেল মণিমালার।ছেলেটা পড়াশোনায় খুবি আগ্রহী।ছুটির পর পায়ে পায়ে

শিবশরণদের বাড়ি গেল মণিমালা।জীর্ণ ভেঙে পরা একটা চালা ঘর।শিবশরণের ঠাকুমা

বাড়িতে ছিলেন।ওনার থেকে মণিমালা জানতে পারলেন-শিবশরণের মা জন্মের সময় মারা

যায়।ঠাকুমাই ওকে মানুষ করেছেন।সম্প্রতি বাবা কারখানায় দাঙ্গা হওয়ায় জেলে

গেছে।তাই অগত্যা শিবশরণকে কাজে লাগতে হয়।মণিমালা বাড়ি ফিরে সেদিন আর কোনোখাবার মুখে তুলতে পারে না।পরের দিন একটু আগে বেরিয়ে শিবশরণের বাড়ি যায়।বুড়ি ঠাকুমাকে বলে আসেন রবিবার ওর বাড়ি যেতে।মণিমালা শিবশরণের ঠাকুমাকে ওর বাড়ির টুকি টাকি কাজ করার জন্য নিয়োগ করে।আর শিবশরণের পড়াশোনার ,খাবারের দায়িত্ব নেয় ওর বাবা ফেরা না পর্যন্ত।এরপর বহু বছর কেটে যায়।শিবশরণের পড়াশোনার খরচ মণিমালাই বহন করেছে।ওর বাবা ফিরে আসবার পরেও।সম্প্রতি শিবশরণ W.B.C.Sপরীক্ষা দিয়েছে।আজ ও W.B.C.Sঅফিসার।শিবশরণ প্রণাম করে হঠাত্‍ বলে ওঠে-মা, ছেলে এসেছে তোমায় নিতে।আমি জানি আজ তোমার রিটায়েরমেন্ট।কিন্তু তোমার ছেলে আর এক দায়িত্ত্ব দেবে তোমায়।মণিমালা হতবাক।মা ডাকে ড়াকছে তাকে।মণিমালাকে হতবাক হতে দেখে শিবশরণ বলে-তুমি তো আমার মা আজ তুমি না খাকলে কোথায় থাকতাম!

কিন্তু মা তোমার ছেলে তোমায় আর এক দায়িত্ত্ব দেবে।আমাদের এলাকায় কর্মপ্রশিক্ষণ,হাতের কাজের প্রশিক্ষণের জন্য আর মেধাবী ছেলেদের কোচিং এর জন্য বিনা বেতনে একটি স্কুল প্রতিষ্টা করবো।যার পরিচালনার ভার তোমার। মণিমালার দুচোখে উপছে পড়া খুশির অশ্রু।বুকের ভিতরটা আদ্র হয়ে ওঠে আকাঙ্খিত মা ডাকে।মা তার ছেলের হাত ধরে পাড়ি দেয় এক নতুন জীবনের শুরুর পথে।

Post a Comment

0 Comments